বাংলাদেশ ২৭ অক্টোবর ২০২৫

পুলিশের গুলিতে আমার মা মারা যায়, ছেলে প্যারালাইজড: ট্রাইবুনালে আবেগাপ্লুত সাক্ষী মোস্তাফিজ

post

নিউজ ডেস্ক
টিভি নাইনটিন অনলাইন

ঢাকাঃ
বাবাকে খাবার পৌঁছে দিতে বাসা থেকে বের হলে ছেলে মুসা আইসক্রিম খেতে চায়। তখন আমার মা ও ছেলেকে নিয়ে বাসার নিচে নামি। বাসার নিচের নামার পরই গেটের বাইরে থেকে পুলিশের গুলি এসে আমার ছেলের মাথা ভেদ করে বের হয়ে যায়। সেই একই গুলি লাগে মায়ের পেটে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় মা মারা যায়। ছেলেরও এখন একপাশ প্যারালাইজড (পক্ষাঘাতগ্রস্ত)।গত বছরের জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর রামপুরায় ছাদের কার্নিশে ঝুলে থাকা আমির হোসেনকে গুলি করাসহ দু’জনকে হত্যার ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় দেওয়া জবানবন্দিতে এসব কথা বলেন সাক্ষী মো. মোস্তাফিজুর রহমান।বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ আজ এ মামলায় প্রসিকিউশনের দ্বিতীয় সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন তিনি। পরে তাকে জেরা শেষ করেছেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। এ মামলার পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের দিন আগামী ৩ নভেম্বর ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল।এদিকে, কুষ্টিয়ায় ৬ জনকে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফসহ চারজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন প্রশ্নে প্রসিকিউশনের শুনানি শেষ হয়েছে।রামপুরার ঘটনার এই মামলায় সাবেক ডিএমপি কমিশানর হাবিবুর রহমানসহ মোট আসামি পাঁচজন। এর মধ্যে একমাত্র গ্রেফতার আসামি রামপুরা পুলিশ ফাঁড়ির সাবেক এএসআই চঞ্চল চন্দ্র সরকারকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করে পুলিশ। পলাতক বাকি তিন আসামি হলেন— খিলগাঁও জোনের সাবেক এডিসি মো. রাশেদুল ইসলাম, রামপুরা থানার সাবেক ওসি মো. মশিউর রহমান ও রামপুরা থানার সাবেক এসআই তারিকুল ইসলাম ভূঁইয়া।জবানবন্দির শুরুতেই নিজের পরিচয় তুলে ধরেন গুলিবিদ্ধ মুসার (০৬) বাবা মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘গত বছর ১৯ জুলাই শুক্রবার বিকেল আনুমানিক ৩টা থেকে সাড়ে ৩টার সময় আমার বাবাকে খাবার পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় আমার ছেলে মো. বাসিত খান মুসা আইসক্রিম খেতে চায়। তখন আমি আমার মা ও ছেলেকে নিয়ে বাসার নিচে নামি। মাকে বলি আইসক্রিম কিনে দেওয়ার পর আমার ছেলেকে নিয়ে মা যেন বাসায় চলে যায়। বাসার নিচে নামার পর গেইটের বাহির থেকে পুলিশের ছোঁড়া একটি গুলি আমার ছেলের মাথা ভেদ করে পেছন দিয়ে বের হয়ে যায়। আমি তাৎক্ষণিকভাবে ছেলেকে কোলে নিয়ে পার্শ্ববর্তী ফেমাস হাসপাতালে নিয়ে যাই।’

জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ‘আমার বাসা থেকে আনুমানিক ৭০ ফুট দূরে রামপুরা থানা ভবন অবস্থিত। বাসার গেইট থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম-থানার ওসি মশিউর রহমানসহ আরো কয়েকজন পুলিশ সদস্য সরাসরি গুলি করছিল।তিনি বলেন, ‘ফেমাস হাসপাতালের ডাক্তার প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে দ্রুত আমার ছেলেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে বললে আমি অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই। ফোন করলে আমার বাবা ও স্ত্রী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসে। আমার ছেলের মাথায় ডাক্তাররা অপারেশন করে। তখন আমি আমার মাকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তাকে বার বার ফোন করেও পাইনি। পরবর্তীতে আমার এক প্রতিবেশীকে ফোন করে আমার ফ্ল্যাটে গিয়ে আমার মায়ের খোঁজ করতে বলি। তিনি আমাকে জানান, আমার ছেলের মাথায় যে গুলিটি লেগেছিল, সেই গুলিটি আমার ছেলের মাথা ভেদ করে আমার মায়ের পেটে লেগেছে। আমি তাৎক্ষণিকভাবে আমার ছেলেকে নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে আসায় মায়ের গুলি লাগার বিষয়টি জানতে পারিনি।জবানবন্দিতে মশিউর রহমান বলেন, ‘প্রতিবেশীরা মাকে ফরাজি হাসপাতালে ভর্তি করেছে বলে জানায়। তারা আমাকে বলে, কাউকে যেন হাসপাতালে পাঠাই।সাক্ষী বলেন, ‘বাইরে অনেক গুলাগুলি হওয়ার কারণে আমরা কেউ ঢাকা মেডিকেল থেকে বের হয়ে ফরাজী হাসপাতালে যেতে পারছিলাম না। আমি আমার এক আত্মীয়কে ফোন করে দ্রুত ফরাজী হাসপাতালে যেতে বলি। আমার আত্মীয় হাসপাতালে গিয়ে জানায়, ডাক্তাররা মাকে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেছে। গাড়ি না পাওয়ায় তিনি আমার মাকে ঢাকা মেডিকেলে আনতে পারেননি। বাইরে তখন অনেক গোলাগুলি হচ্ছিল।জবানবন্দিতে তিনি আরো বলেন, ‘পরদিন ভোর ৫টার দিকে আমি ঢাকা মেডিকেল থেকে একটি অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে ফরাজী হাসপাতালে পাঠাই। ওই অ্যাম্বুলেন্সে করে মাকে নিয়ে বাবা ঢাকা মেডিকেলে আসেন। পথে মায়ের অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। ঢাকা মেডিকেলে নামানোর পর ডাক্তাররা মায়ের ইসিজি করেন এবং তাকে মৃত ঘোষণা করেন। আমার মায়ের লাশ মর্গে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন আমার ছেলে আইসিইউতে ছিল।তিনি আরো বলেন, ‘আমি আমার মায়ের লাশ নিতে চাইলে মেডিকেল কর্তৃপক্ষ জানায়, যেহেতু সে রামপুরা থানা এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়েছে, তাই লাশ নিতে হলে রামপুরা থানা পুলিশের অনুমতি লাগবে। আমি রামপুরা থানার ওসির মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে তাকে ফোন করে অনুরোধ করি— থানা থেকে একজন পুলিশ সদস্য ঢাকা মেডিকেল কলেজে পাঠাতে। পরে ওইদিন দুপুরে দু’জন সাব-ইন্সপেক্টর সিভিল পোশাকে ঢাকা মেডিকেলে আসেন। তারা বলেন, যেহেতু লাশ গুলিবিদ্ধ তাই লাশ এখন দেওয়া যাবে না। অনেক অনুরোধের পরও তারা লাশ দিতে রাজি হয়নি। পরবর্তীতে লাশ নিয়ে রামপুরা না যাওয়ার শর্তে তারা দিতে রাজি হয়। তাদের কথা মতো আমার বাবা লাশ নিয়ে টাংগাইলের মির্জাপুর থানায় গ্রামের বাড়িতে নিয়ে দাফন করে। আমার ছেলে আইসিউতে থাকায় আমি আমার মায়ের লাশের সাথে যেতে পারিনি।তিনি বলেন, আমার ছেলে গত বছর ২৬ আগস্ট পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেলের আইসিইউতে ভর্তি ছিল। পরে তাকে সিএমএইচে নিয়ে যাওয়া হয়। ২২ অক্টোবর পর্যন্ত সেখানে আইসিইউতে ছিল। ছেলে অবস্থার অবনতি হতে থাকলে চিকিৎসকরা তাকে সিংগাপুরে চিকিৎসার জন্য পাঠানোর পরামর্শ দেয়। ২৩ অক্টোবর থেকে ৩ এপ্রিল পর্যন্ত সিঙ্গাপুরে ছেলের চিকিৎসা চলে। ৯ জুলাই পুনরায় সিঙ্গাপুরে নেওয়া হয়। এই দফায় ২৬ জুলাই পর্যন্ত সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা গ্রহণ করেছে। ছেলের ডানদিক এখন প্যারালাইজড (পক্ষাঘাতগ্রস্ত)। কথাও বলতে পারে না। চলাফেরাও করতে পারে না।এ পর্যায়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে সাক্ষী মায়ের হত্যা ও ছেলের এই পক্ষাঘাতগ্রস্ত অবস্থার জন্য দায়ীদের বিচার চান।

এই ট্রাইব্যুনালে কোনো অস্বচ্ছতা নেই: আসামিপক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী বর্তমান আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কোনো অস্বচ্ছতা নেই এবং ক্যাঙারু কোর্ট মনে করেন না বলে মন্তব্য করেছেন রামপুরার মামলায় আসামিপক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন। আজ দুপুরে ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে এক ব্রিফিংয়ে তিনি এ মন্তব্য করেন। আমির হোসেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীয় আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষেও রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী হিসেবে রয়েছেন।ট্রাইবুনালের বিচারিক স্বচ্ছতা নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যারা ক্যাঙারু বলেন এটা তাদের ব্যাপার। তবে আমি মনে করি না অস্বচ্ছতার কোনো কিছু আছে। কারণ, এ পর্যন্ত ট্রাইব্যুনালের কোনো পক্ষ আমাকে কোনোভাবে চাপ দেয়নি। কেউ বলেননি যে, এটা বলবেন না, এটা করবেন না। এভাবে কখনোই কেউ কিছু করেননি। অতএব এই কোর্ট ক্যাঙারু কি না এই প্রশ্নের আমি জবাব দেব না। আমি মনে করি না যে, এই কোর্ট কোনো ক্যাঙারু। কারণ আমাকে কেউ কোনো বাধার সৃষ্টি করেনি।

হানিফসহ ৪ জনের অভিযোগ গঠন প্রশ্নে প্রসিকিউশনের শুনানি শেষ:

জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে কুষ্টিয়ায় ৬ জনকে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফসহ চারজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের বিষয়ে প্রসিকিউশনের শুনানি শেষ হয়েছে। গতকাল বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ, প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। পরে আসামিপক্ষের শুনানির জন্য আগামী মঙ্গলবার পর্যন্ত এ মামলার কার্যক্রম মুলতবি করেছেন ট্রাইব্যুনাল।এ মামলার অন্য তিন আসামি হলেন-কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি সদর উদ্দিন খান, জেলা সাধারণ সম্পাদক আজগর আলী ও শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান আতা। তারা চারজনই পলাতক।এর আগে গত ২৩ অক্টোবর হানিফসহ চারজনের পক্ষে রাষ্ট্রীয় খরচে আইনজীবী নিয়োগ দেন ট্রাইব্যুনাল। একইসঙ্গে অভিযোগ গঠনের ওপর শুনানির জন্য দিন নির্ধারণ করা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় সোমবার শুনানি করে প্রসিকিউশন। প্রসিকিউশন গত ৫ অক্টোবর ট্রাইব্যুনাল-২-এ চার আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে। এতে সুনির্দিষ্ট তিনটি অভিযোগ আনা হয়। এর মধ্যে রয়েছে উসকানিমূলক বক্তব্য, ষড়যন্ত্র ও কুষ্টিয়ায় ছয়জনকে হত্যা। উল্লেখ্য, জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান ঘিরে কুষ্টিয়ায় ছয়জন হত্যার শিকার হন। একই সঙ্গে আহত হন বেশ কয়েকজন।

আরো পড়ুন!

Sidebar Banner
Sidebar Banner